স্যার ১০ হাজার টাকার নিচে নেন না / অফিস সহায়ককে ভয় পান জেলার শীর্ষ কর্মকর্তা/ জেলা নির্বাচন কমিশনার সপ্তাহে ৩/৪ দিন অবস্থান করেন ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাচন অফিসে
ঈশ্বরদীর নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সেবাপ্রত্যাশিদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, টাকা ছাড়া কোন কাজই হয়না। নতুন ভোটার হওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল সংশোধন করাসহ সকল কাজেই গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। অন্যথায় ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। এনিয়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগীরা।
ঈশ্বরদীর মুলাডুলি এলাকার রেশমা খাতুন৷ এক বছর আগে স্বামীর সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়। এ কারণে জাতীয় পরিচয় পত্রে স্বামীর নামের পরিবর্তে বাবার নাম যুক্ত করতে যান উপজেলা নির্বাচন অফিসে। তবে দীর্ঘদিন ঘোরাঘুরির পরেও নাম পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। পরে সুযোগ বুঝে সেখানকার অফিস সহায়ক কর্মচারী শওকত আলী নাম পরিবর্তন করার জন্য উপজেলা নির্বাচন অফিসার আশরাফুল হককে দিতে হবে বলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও নাম পরিবর্তন করেনি নির্বাচন অফিস।
ভুক্তভোগী রেশমা খাতুন বলেন, এক বছর আগে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়। তাই স্বামীর নাম পরিবর্তন করতে নির্বাচন অফিসে গেলে তারা কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং আমার কাছে টাকা দাবি করে। ২-৪ হাজার টাকা হলে একটা বিষয় থাকে ৫০ হাজার টাকা দাবী করে তারা। এতো টাকা আমি কোথায় পাবো। এখন আমি টাকা দিতে পারিনি তাই মাসের পর মাস চলে যায় কোন কাজ হয় না। ঈশ্বরদী অফিসের শওকত নামের একজন এই ৫০ হাজার টাকা দাবি করে আমার কাছে। ঈশ্বরদী নির্বাচন অফিসার আশরাফুল হককে নাকি দিতে হবে এই টাকা। টাকা না দিলে তিনি নাকি কাজ করে না।
ভুক্তভোগী রেশমা খাতুন আরো বলেন, যারা আমার কাছে টাকা দাবি করলো তারা তো সরকারি চাকরি করেন। তাদের কি সরকার বেতন দেয়না। তারা তো সরকারের বেতন পায় তাহলে আমাদের কাছে কেন টাকা চায়। এসব অফিসারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এদের কারণে দেশ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হচ্ছে।
শুধু রেশমা খাতুন নয়, এমন হয়রানির অভিযোগ ওই এলাকার অনেক মানুষের। তাদের অভিযোগ, টাকা না দিলে কোনো কাজ করেন না ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নতুন ভোটার হওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল সংশোধন করাসহ সব কাজেই গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। এমন অপরাধে সাহায্য করে ওই অফিসের অফিস সহায়ক শওকত আলী। অন্যথায় ঘুরতে হয় বছরের পর বছর।
এদিকে নির্বাচন অফিসে নতুন ভোটার আইডি কার্ড করতে আসা কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ফিঙ্গার ও ছবি তোলার জন্য ট্রেজারী চালানের কথা বলে ৪৫০ টাকা নেয় অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ঐ টাকা না দিলে ফিঙ্গার নেয় না তারা।
নির্বাচন অফিস সংলগ্ন জমি রেজিষ্ট্রি করতে আসা কয়েকজন বলেন, ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাচন অফিসে সাপ্তায় তিন/চার দিন জেলা নির্বাচন কমিশনার আসেন এবং সারাদিন থাকেন। তারা বলেন, কি জন্য আসেন, অবশ্যই অবৈধ অর্থের ভাগ নিতে আসেন।
উপজেলার মাসুদ রানা নামের একজন জানায়, ২০১৬ সালে নামের পরিবর্তন করতে উপজেলা নির্বাচন অফিসে জমা দেই। এখন পর্যন্ত নামের পরিবর্তন হয়নি। ঈশ্বরদী নির্বাচন অফিসে কর্মকর্তাদের দাবি, পাবনা অফিস রাজশাহী অফিস এবং ঢাকা অফিসে টাকা দিয়ে এসব নাম পরিবর্তন করে আনা লাগে। এ কারণে আমাদের থেকে টাকা দাবি করে তারা। টাকাও দেই নি নামও ঠিক হয়নি। এছাড়া ওই অফিসের কর্মচারীদের মুখ খুব খারাপ। বাজে বাজে ভাষায় কথা বলে আর বকাবাদ্য করে।
শাহীন আলম নামের একজন ভুক্তভোগী জানান, আমার জন্ম নিবন্ধন কার্ডের সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ডের মিল নেই। ভোটার আইডি কার্ডে তিন বছর বেশি দেওয়া রয়েছে। এই তিন বছর ঠিক করতে প্রতিটি বছর বাবদ ১০ হাজার করে টাকা দাবি করেন ঈশ্বরদী অফিসের স্টাফরা।
রিপন হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী জানান, আমি আমার ভোটার আইডি কার্ড সংশোধন করতে গেলে, শওকত আলী নামের এক জন কর্মচারী আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কি জন্য টাকা দিতে হবে প্রশ্নের জবাবে শওকত আলী বলেন, আমাদের নির্বাচন অফিসার আশরাফুল হককেই দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। স্যার ১০ হাজার টাকার নিচে নেন না। আর বাকি পাঁচ হাজার আমরা আরো কয়েকজন আছি সবাই চা খাবো।
এদিকে এসব বিষয়ে কথা বলতে বারবার উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আশরাফুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। অবশ্য, সহকারী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার রায়ের দাবি, অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। হয়তো অফিসের বাইরের কেউ দুর্নীতি করে অফিসের নামে কুৎসা রটাচ্ছে। আমরা এখনো সঠিক কোন অভিযোগ পাইনি। ভালোমতো সঠিক অভিযোগ পেলে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ।
আর, অভিযোগ অস্বীকার করেন অভিযুক্ত অফিস সহায়ক। তিনি বলেন আমি কোন প্রকারের টাকা নেই না। এগুলা সব মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন। কে টাকা নেয় বা না নেয় সেটা আমি জানি না। এসব বলে কোন লাভ নেই।
এদিকে, জেলা নির্বাচন অফিস বরাবর হয়রানি থেকে মুক্তি এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে লিখিত অভিযোগ করেন কয়েকজন ভুক্তভোগী। তবে লিখিত অভিযোগ পেলেও জেলা নির্বাচন অফিসের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমানের দাবী ঈশ্বরদী বা পাবনা অফিসের কোন কর্মকর্তা কর্মচারী কেউ টাকা নেয় না। তবে কেও টাকা নেয়না এটা জানেন কিভাবে এমন প্রশ্ন করলে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি জেলা অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা। পরবর্তীতে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন সাংবাদিকদের উপরে। উল্টো ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন সাংবাদিকদের।
এদিকে ঘুষ গ্রহণ করে সকল অফিসারকে দেওয়া সেই শওকতের বিষয়ে জানতে জেলা নির্বাচন অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শওকতের অনেক বড় হাই লবিং আছে। একবার তার বিরুদ্ধে অফিশিয়ালে ব্যবস্থা নিতে চাইছিলাম সচীব পর্যায়ের লোকজন আমাকে ফোন দিয়েছিল। তাই শওকতের বিরুদ্ধে কোন কিছু করবো না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি।